কারিগরি শিক্ষা: একটি জাতিকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দেওয়ার শক্তি
লিখেছেন : পিন্টু কুমার মন্ডল
(বি.এস.সি ইন ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং-ইইই)
একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভর করে তার মানবসম্পদ, প্রযুক্তি দক্ষতা, এবং শিল্পোন্নয়নের উপর। কারিগরি শিক্ষা সেই ভিত্তি, যা একটি জাতিকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর করে, প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে তোলে এবং বেকারত্বের হার কমিয়ে উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করে। আজকের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে যে কোনো উন্নয়নশীল দেশের জন্য কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।
১. দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে কারিগরি শিক্ষার অবদান
কারিগরি শিক্ষা কর্মমুখী জ্ঞান ও দক্ষতার উপর ভিত্তি করে তৈরি। এটি শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে কাজ শেখায়, বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ করে দেয়। একটি দেশে যখন বিপুল সংখ্যক যুব সমাজ দক্ষ কারিগরি জ্ঞান নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে, তখন উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়, শিল্পে গতি আসে এবং পরনির্ভরশীলতা কমে। যেমন—ইলেকট্রিশিয়ান, ওয়েল্ডার, মেশিন অপারেটর, সফটওয়্যার ডেভেলপার, নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার, CNC মেশিন অপারেটর ইত্যাদি পেশাজীবীরা উন্নয়নের সরাসরি চালিকা শক্তি।
২. বেকারত্ব হ্রাস ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কারিগরি শিক্ষা
সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী পাস করলেও তারা কর্মসংস্থানে যুক্ত হতে পারছে না মূলত দক্ষতার অভাবে। কিন্তু কারিগরি শিক্ষা গ্রহণকারীরা সহজেই কর্মক্ষেত্র খুঁজে পান, এমনকি অনেকেই নিজের উদ্যোগে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গড়ে তোলেন। এর ফলে রাষ্ট্রের উপর বেকার ভাতার চাপ কমে, যুবসমাজ আত্মনির্ভরশীল হয় এবং অর্থনীতির চাকা সচল হয়।
উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে পাস করে অনেক শিক্ষার্থী গার্মেন্টস, কনস্ট্রাকশন, তথ্য প্রযুক্তি, রোবটিকস ও অটোমেশন খাতে দক্ষ কর্মী হিসেবে কাজ করছে, অনেকে বিদেশেও কর্মরত।
৩. শিল্প ও উৎপাদন খাতে উন্নয়নে কারিগরি শিক্ষার ভূমিকা
যেকোনো শিল্প খাতে মেশিন চালানো, রক্ষণাবেক্ষণ, ডিজাইন, উন্নয়ন—সবই দক্ষ কারিগরি জনশক্তির মাধ্যমে সম্ভব হয়। কৃষি খাতেও বর্তমানে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেখানে কৃষি প্রকৌশল ও কৃষিভিত্তিক প্রযুক্তি শিক্ষার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।
শিল্পের সঙ্গে কারিগরি শিক্ষা যদি ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত থাকে, তাহলে দেশ নিজের চাহিদা মেটাতে পারে এবং রপ্তানিমুখী পণ্য ও সেবা তৈরি করতে পারে। এইভাবে দেশ রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করে বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে পারে।
৪. উদ্যোক্তা তৈরি ও আত্মকর্মসংস্থান নিশ্চিত করা
কারিগরি শিক্ষা শুধু চাকরি পাওয়ার পথ নয়, বরং উদ্যোক্তা হওয়ার পথও। একজন দক্ষ কারিগরি শিক্ষার্থী নিজের মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপ, কম্পিউটার সার্ভিসিং সেন্টার, মোবাইল রিচার্জ/রিপেয়ারিং সেন্টার, ডিজাইন হাউস, কিংবা আইটি ফার্ম গড়ে তুলতে পারেন। এক্ষেত্রে সরকার যদি সহজে ঋণ, প্রশিক্ষণ ও বাজার সংযোগ নিশ্চিত করে, তাহলে বিপুল সংখ্যক উদ্যোক্তা গড়ে উঠবে, যা উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি।
৫. বিদেশে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে ভূমিকা
বর্তমানে অনেক দেশ যেমন—জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপে বিভিন্ন কারিগরি পেশাজীবীর চাহিদা ব্যাপক। দক্ষ টেকনিশিয়ান, মিস্ত্রি, হেলথ টেকনিশিয়ান, আইটি পেশাজীবী, কুক, প্লাম্বার—এ ধরনের কাজের জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়।
বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য এই রেমিট্যান্স একটি প্রধান অর্থনৈতিক স্তম্ভ। তাই দেশের কারিগরি শিক্ষার মান ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের দিকেও নজর দেওয়া জরুরি।
৬. প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও গবেষণার মূলে কারিগরি শিক্ষা
কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকলে এবং শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী শক্তিকে উৎসাহিত করা হলে দেশীয় প্রযুক্তির বিকাশ সম্ভব। উদ্ভাবন বা ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সংযোগের মাধ্যমে ছোট ছোট প্রযুক্তিগত সমাধান দিয়েও জাতীয় সমস্যা সমাধান সম্ভব। যেমন—স্থানীয়ভাবে তৈরি ইকোনমিক সোলার প্যানেল, স্মার্ট হেলথ মনিটরিং সিস্টেম, স্বল্পমূল্যের আইআর সেন্সর ডিভাইস, কিংবা ড্রোন প্রযুক্তি—সবই কারিগরি শিক্ষা থেকে আসা উদ্ভাবনের ফল।
৭. নারীর ক্ষমতায়নে কারিগরি শিক্ষার ভূমিকা
কারিগরি শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির ফলে তারা গার্মেন্টস, স্বাস্থ্যসেবা, গ্রাফিক ডিজাইন, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, হস্তশিল্প কিংবা ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে দক্ষ হয়ে উঠছে। এতে নারীর আত্মনির্ভরতা যেমন বাড়ছে, তেমনি সমাজে তাদের মর্যাদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারী-পুরুষের যৌথ অংশগ্রহণ ছাড়া একটি পূর্ণাঙ্গ উন্নয়ন সম্ভব নয়।
৮. স্মার্ট বাংলাদেশ ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবেলায় প্রস্তুতি
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মূল উপজীব্য—আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবটিকস, আইওটি, বিগ ডেটা, অটোমেশন—সব কিছুই কারিগরি শিক্ষার পরিধির মধ্যে পড়ে। “স্মার্ট বাংলাদেশ ” গড়ে তুলতে হলে এই সকল প্রযুক্তিতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি ছাড়া বিকল্প নেই। তাই এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার পরিধি বাড়াতে হবে।
৯. সরকারের ভূমিকা ও করণীয়
কারিগরি শিক্ষাকে উন্নয়নের মূলধারায় নিতে হলে সরকারের উচিত হবে:
- প্রতিটি উপজেলায় আধুনিক পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন করা
- কারিকুলামকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করা
- ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সংযোগ তৈরি করা
- প্রাতিষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ বাড়ানো
- নারী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ স্কলারশিপ
- উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ ও ইনকিউবেশন সেন্টার গড়ে তোলা
কারিগরি শিক্ষা কেবল শিক্ষাব্যবস্থার একটি শাখা নয়, বরং এটি একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মেরুদণ্ড। একজন দক্ষ কারিগরি শিক্ষার্থী কেবল নিজের জন্য নয়, পুরো সমাজ, শিল্প, এবং জাতির জন্য অবদান রাখে। একটি উন্নয়নশীল দেশকে উন্নত দেশের সারিতে স্থান করে নিতে হলে কারিগরি শিক্ষার প্রসার ও মানোন্নয়ন অপরিহার্য। তাই আমাদের উচিত হবে এই শিক্ষাখাতে অধিক গুরুত্ব প্রদান করে যুগোপযোগী দক্ষতা ভিত্তিক জাতি গঠনে একযোগে কাজ করা।